প্রবাসিরা কি সব সময়ই অবহেলিত থাকবে?
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি পরিবর্তনশীল মুহূর্ত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ অভ্যুত্থান ন্যায়বিচার ও সংস্কারের জন্য একটি সম্মিলিত দাবি জানাতে ছাত্র, সাধারণ জনগণ, শ্রমিক, অভিবাসী এবং প্রবাসীদের একত্রিত করেছিল। এই গণ–অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের অভিবাসী কর্মী এবং প্রবাসী সম্প্রদায়ের অবদান ছিল অসাধারণ। তাঁরা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘লাইফলাইন’ হিসেবে রেমিট্যান্স কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে দেন এবং আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে গণ–অভ্যুত্থানের দাবি জোরালো করতে বৈশ্বিক বিক্ষোভ সংগঠিত করেছিল।
জাতির ভবিষ্যৎ গঠনে তাঁদের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সত্ত্বেও অভিবাসন এবং প্রবাসীদের ইস্যু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অ্যাজেন্ডায় দৃশ্যমান নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামী তাদের রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা এবং ৪১ দফা সংস্কার পরিকল্পনা পেশ করেছে। তাদের অ্যাজেন্ডায় সংবিধান–বিচার বিভাগ–নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়গুলো থাকলেও অভিবাসন বা প্রবাসীদের ইস্যু অন্তর্ভুক্ত নেই। এটি অত্যন্ত হতাশাজনক। অভিবাসন ও প্রবাসীদের ইস্যুর সম্পৃক্তি কোনো গৌণ বিষয় নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতি, সামাজিক কাঠামো এবং জাতীয় পরিচয়ের একটি ভিত্তি।
জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ডের প্রতি ‘বিশ্বাসঘাতকতা’
রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা থেকে অভিবাসন ও প্রবাসীদের ইস্যু বাদ দেওয়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তিকে দুর্বল করে। প্রতিবছর ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স প্রেরণকারী অভিবাসী কর্মীরা দেশের জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি অবদান রাখেন, যা বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম বৃহৎ উৎস। এই অর্থ লাখো পরিবারকে টিকিয়ে রাখে, দারিদ্র্য হ্রাস করে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে অর্থায়ন করে। এ খাতকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডকে অবজ্ঞা করছে।
অভিবাসনকে উপেক্ষা করা নিছক একটি ভুল নয়—এটি এমন লাখো কর্মীর প্রতি একটি সক্রিয় অবহেলা, যাঁরা তাঁদের পরিবার ছেড়ে বিদেশে কঠোর পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করেন। যখন রাজনৈতিক নেতারা তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মনোযোগ দেন এবং অভিবাসীদের অবদান উপেক্ষা করেন, এটি একটি বড় বিশ্বাসঘাতকতার চেয়ে কম কিছু নয়।
অভিবাসন কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়—এটি বাংলাদেশের চার কোটির বেশি মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। অভিবাসী পরিবারের সদস্যরা ভোটারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গঠন করে। তাদের উদ্বেগগুলো উপেক্ষা করে রাজনৈতিক দলগুলো এমন একটি জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছে, যারা ঐতিহাসিকভাবে অবহেলিত কিন্তু গ্রামীণ এবং আধা-শহুরে এলাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী।
রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে অভিবাসী পরিবারের কণ্ঠস্বর উপেক্ষা করা কেবল ভোটের হিসেবে নেতিবাচক নয়, বরং এমন একটি গোষ্ঠীকে আরও প্রান্তিক করবে, যারা ইতিমধ্যেই দেশের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। এই উপেক্ষা তাদের অবদান এবং ত্যাগের প্রতি একটি বড় অবমাননা।
২০২৪ সালের জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থান ছিল একটি সংজ্ঞায়িত মুহূর্ত যা ন্যায়বিচার, সমতা এবং সংস্কারের জন্য ছাত্র, শ্রমিক এবং প্রবাসীদের একত্র করেছিল। অভিবাসী এবং প্রবাসী সম্প্রদায় তাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বন্ধ করে এবং বিক্ষোভ সংগঠিত করে অভ্যুত্থানের বার্তাকে শক্তিশালী করে। তাদের অংশগ্রহণ এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছিল।
অভিবাসন এবং প্রবাসীদের ইস্যু উপেক্ষা করে রাজনৈতিক দলগুলো সেই অন্তর্ভুক্তি ও ঐক্যের চেতনার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে, যা গণ–অভ্যুত্থানকে সংজ্ঞায়িত করেছিল। যাঁরা এই সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের বাদ দিয়ে নেতারা কীভাবে অভ্যুত্থানের আদর্শ ধরে রাখার দাবি করতে পারেন?