সন্ত্রাস ও কালো টাকা নিরসনে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন কেন জরুরি

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নির্বাচন হলো জনগণের অংশগ্রহণ ও মতামত প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, নির্বাচনের সময় প্রায়ই সহিংসতা, কালো টাকা, এবং প্রভাব খাটানোর প্রবণতা বেড়ে যায়। এর মূল কারণগুলোর একটি হলো আমাদের বিদ্যমান “একক প্রার্থী বিজয়ী” বা প্রথম-ভোট-গণনা-ভিত্তিক (First-Past-The-Post) নির্বাচন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে একজন প্রার্থী মাত্র কয়েক শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে—ফলে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা হয় “জয়-পরাজয়ের যুদ্ধ”, যেখানে টিকে থাকার জন্য দলগুলো প্রায়ই টাকার জোর, বাহুবল, এবং ভয়ভীতির আশ্রয় নেয়।

এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য অনেক বিশেষজ্ঞই প্রস্তাব করেছেন পিআর (Proportional Representation) বা অনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি। কেন এই পদ্ধতি সন্ত্রাস ও কালো টাকার ব্যবহার কমাতে সহায়ক হতে পারে, তা নিচে ব্যাখ্যা করা হলো।

১. পিআর পদ্ধতিতে ভোটের মূল্য সমান থাকে
বর্তমান ব্যবস্থায় অনেক ভোট ‘নষ্ট’ হয়ে যায়—যে প্রার্থী হেরে যায়, তার ভোট কার্যত সংসদে কোনো প্রভাব ফেলে না। পিআর পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোটই গণনায় আসে, কারণ দলীয়ভাবে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন হয়। ফলে ভোট কেনা বা ভীতি প্রদর্শনের প্রয়োজন কমে যায়, কারণ “কিছু এলাকায়” প্রভাব বিস্তার করে বড় লাভ তোলা যায় না।

২. সহিংসতার সুযোগ কমে যায়
বর্তমান ব্যবস্থায় একটি আসনে জয় মানেই বড় রাজনৈতিক লাভ, তাই স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাসীরা সক্রিয় থাকে। কিন্তু পিআর ব্যবস্থায় আসন নির্ভর নয়; জাতীয়ভাবে ভোট গণনা হয়। ফলে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় দখলদারিত্ব বা ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণের প্রণোদনা কমে যায়। এতে নির্বাচনী সহিংসতার আশঙ্কাও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।

৩. কালো টাকার প্রভাব কমে
এফপিটিপি পদ্ধতিতে একজন প্রার্থীকে একটি আসনে বিপুল খরচ করতে হয়—পোস্টার, মিছিল, কর্মী, এমনকি ভোট কিনতেও। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে দলভিত্তিক প্রচারণা হয়, যা তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছ এবং গণমাধ্যম-নির্ভর। এতে ব্যক্তিগত অর্থব্যয়ের সুযোগ কমে যায় এবং কালো টাকার প্রবাহও নিয়ন্ত্রণে আসে।

৪. ছোট দল ও নতুন নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি হয়
পিআর পদ্ধতি ছোট দল ও নতুন নেতৃত্বকে সুযোগ দেয়, কারণ আসন বণ্টন ভোটের অনুপাতে হয়। এতে রাজনীতিতে অর্থ ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর আধিপত্য কমে, এবং নীতিনিষ্ঠ রাজনীতিবিদদের বিকাশের সম্ভাবনা বাড়ে।

৫. জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়
যখন সব দল ভোটের অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব পায়, তখন সংসদে আলোচনার সংস্কৃতি বৃদ্ধি পায়। ‘বিজয়ী সব পাবে, পরাজিত কিছুই পাবে না’ ধরনের বিভাজন কমে যায়। এতে রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি হ্রাস পায়।

বাংলাদেশে সন্ত্রাস, কালো টাকা, এবং নির্বাচনী সহিংসতা কমাতে নির্বাচন পদ্ধতিতে সংস্কার সময়ের দাবি। পিআর পদ্ধতি কেবল একটি কারিগরি পরিবর্তন নয়, বরং এটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তনের পথ খুলে দিতে পারে। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহনশীল ও স্বচ্ছ গণতন্ত্র গঠনের জন্য অনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি এখনই বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।

Maniruzzaman

I am Maniruzzaman, a free thinker and political commentator, dedicated to unraveling the complexities of Bangladesh’s political landscape.

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button